এই তারিখে
গুয়ে মঠ
বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস
লাহুল-স্পিটি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মহিমান্বিত নীলগিরি পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত, বাঁদিপুর অরণ্য একটা শ্বাসরুদ্ধকর অভয়ারণ্য যেখানে প্রকৃতি তার বিশুদ্ধতম রূপে বিরাজমান। ৮০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, সবুজের এই লীলাভূমি নীলগিরি জীবজগৎ সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসাবে কাজ করে, যা কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং কেরালার প্রাণবন্ত বন্যপ্রাণীকে সংযুক্ত করে। একসময় মহীশূরের মহারাজাদের জন্য একটা ব্যক্তিগত শিকারের সংরক্ষণাগার ছিল এই বাঁদিপুর, যা পশ্চিমঘাটের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত জাতীয় উদ্যানে পরিণত হয়েছে।
এখানে, আকাশ বাতাস বিদেশী পাখির ডাকে অনুরণিত হয়, ঝরঝরে পাতাগুলো প্রাচীন গাছের গোপন রহস্য ফিসফিস করে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের মধ্য দিয়ে অধরা বেঙ্গল টাইগারের গর্জন প্রতিধ্বনিত হয়। মহিমান্বিত হাতি, নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো চিতা এবং বিভিন্ন ধরণের প্রাণীজগতের একটা বৈচিত্রপূর্ণ আবাসস্থল, বাঁদিপুর কেবল একটা জঙ্গলের চেয়েও বেশি কিছু। এটা জীবনের একটা জীবন্ত পটচিত্র, যা জলপ্রবাহ, তৃণভূমি এবং সবুজ বনভূমি দিয়ে বোনা।
আপনি একজন বন্যপ্রাণী প্রিয়, প্রশান্তি সন্ধানকারী, বা হৃদয়ের দিক দিয়ে একজন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী হোন না কেন, বাঁদিপুর জঙ্গল বন্য প্রাণীদের মধ্যে দিয়ে একটা মন্ত্রমুগ্ধ পরিত্রান প্রদান করে, যেখানে প্রতিটা সূর্যোদয় একটা জীবন্ত চিত্রকলার মতো মনে হয় এবং প্রতিটা পদক্ষেপ একেকটা গল্প উন্মোচন করে যা বলার অপেক্ষায় থাকে। বাঁদিপুরে স্বাগত, যেখানে বন্য হৃদস্পন্দন পৃথিবীর ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে স্পন্দিত হয়।
প্রকৃতির স্বর্গ-ওয়ানাডের হৃদয় ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য আমরা ভোরবেলার সময়টাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কারণ আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঁদিপুর জঙ্গলের মধ্যে যাত্রা করার সময় বন্য প্রাণী দেখা। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, ঘূর্ণায়মান চা বাগান, এবং শান্ত অনুভূতির সাথে, পাহাড়ি স্টেশন বাঁদিপুর আমাদের হৃদয়ে পুষে রাখার মতো দুর্দান্ত স্মৃতি দিয়েছে। কিন্তু এখন, সময় এসেছে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে একটা মহাকাব্যিক অ্যাডভেঞ্চারে যাত্রা করার। কি কি প্রাণী এবং কোন কোন দৃশ্য এই যাত্রাকে অবিস্মরণীয় করে তোলে সেটাই দেখবো বলে সকাল সকাল বাঁদিপুর ন্যাশনাল পার্কের বন্য হৃদয় দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছি, আমি আমার বউ আর আমাদের গাড়ি চালক ফিরোজ ভাই!
বাঁদিপুর জঙ্গল দেখার সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া দক্ষিণ ভারত ঘুরে দেখার সেরা সময়। আমরা যখন ওয়েনাডের নির্মল পাহাড় থেকে নেমেছি, রাস্তাগুলো ঘন বন এবং শ্বাসরুদ্ধকর উপত্যকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। প্রতিটা বাঁক একএকটা অসাধারণ এবং নিখুঁত দৃশ্য প্রকাশ করে। এটা শুধুমাত্র একটা ড্রাইভ নয়, এটা প্রাকৃতিক চিত্রপটের মধ্য দিয়ে একটা যাত্রা যা একটা চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো বদলে যেতে থাকে।
সকালের কুয়াশা ভেদ করে ঘন্টা খানেক গাড়ি এগোনোর পরে আমরা বাঁদিপুর জাতীয় উদ্যানের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেটা ধরে এগোতে থাকি। এই বাঁদিপুর তার সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণী এবং অত্যাশ্চর্য সবুজের জন্য পরিচিত। এই অভয়ারণ্যটা প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটা ভান্ডার। আপনার চোখ যেন সর্বদা সজাগ থাকে, কারণ আপনি কখনই জানতে পারবেন না যে আপনি হঠাৎ হরিণের একটা পাল দেখতে পাবেন। হাতি দেখতে পেতে পারেন, এমনকি অধরা বাঘও।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হরিনের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে গাড়ি এগিয়ে চললো। চোখ আমাদের সজাগ। গতকাল রাতের ঘুমটা ভালো হয়েছে বলেই আজ তেমন ঝিমুনি ভাব নেই। তার উপর হরিণ দেখার পর আরো নানা ধরণের বন্যপ্রাণী দেখার ইচ্ছা বেড়ে গেছে। জঙ্গলটা ঘন এবং সবুজ। রাস্তাটাও মোলায়েম। তাই সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘন্টার রাস্তা অতিক্রম করতে হবে আমাদের। হঠাৎ নজরে এলো রাস্তার পাশেই জঙ্গলের মধ্যে একটা ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সূর্যের আলোতে তার পালক ঝিকমিক করছে। এই ধরনের মুহূর্তগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় কেন বাঁদিপুর একটা জাদুকরী জায়গা। আমাদের গাড়ি থামলো। ভালো করে দেখার জন্য আমাদের এই থামা। আমরা দেখলাম ময়ূরটা ধীরে ধীরে বোনের ভিতর প্রবেশ করে গেলো। মনে রাখবেন, বন্যপ্রাণী ঘনিষ্ঠভাবে দেখার জন্য থামতে হয়, যেটা বন্যপ্রাণীকে সম্মান জানানো। এই আশ্চর্যভূমি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এটাই মূল চাবিকাঠি।
এই যাত্রাপথের রাস্তাটা কিছুটা স্বপ্নের মতোই। লম্বা গাছগুলো উপরে একটা প্রাকৃতিক ছাউনি তৈরি করে, যা সূর্যের আলো ফিল্টার করে, মাটিতে সোনালী ছায়া তৈরি করে। এ এক প্রসারিত বিশুদ্ধ প্রশান্তি, এমন একটা জায়গা যেখানে মনে হয় সময়ও ধীর হয়ে যায়।
বাঁদিপুরকে পিছনে ফেলে, কর্ণাটকের মনোমুগ্ধকর গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাত্রা চলতে থাকে। সোনার ক্ষেতগুলো অবিরামভাবে প্রসারিত, ছোট গ্রাম এবং দূরবর্তী পাহাড় দ্বারা বিরামচিহ্নিত। বন্য বন এবং শান্ত কৃষিভূমির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া এই সড়ক এই ভ্রমণকে সত্যিই মহাকাব্যিক করে তোলে।
ওয়ায়ানাডের নির্মল পাহাড় থেকে বাঁদিপুরের অদম্য বন্য, এবং অবশেষে ব্যাঙ্গালোরের প্রাণবন্ত রাস্তায়—এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। আপনি প্রকৃতি প্রেমী হোন, রোড ট্রিপ উত্সাহী হোন, অথবা দুঃসাহসিক অভিযান খুঁজছেন, তাহলে এই রুটটা আপনার নাম ধরেই ডাকছে। আপনি কি আপনার নিজের মহাকাব্য বাঁদিপুর জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে রোড ট্রিপের গল্প তৈরি করতে প্রস্তুত?
সেই রাতে, শহরের হোটেল রুমে আরামে শুয়ে থাকার সময়, আমার মন আবার সেই বাঁদিপুর বনে ঘুরে বেড়ায়। বিশুদ্ধ প্রকৃতির ঘ্রাণ, হাতিদের দেখা, পাখির কিচিরমিচির শব্দ—তারা আমার আত্মাকে সমৃদ্ধ করে। ওয়েনাড থেকে ব্যাঙ্গালোর পর্যন্ত রাস্তার ট্রিপটা শুধুমাত্র মাইলের পর মাইল জুড়ে ভ্রমণ ছিল না বরং একটা আলাদা জগতের মধ্য দিয়ে একটা দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। প্রকৃতির কোল থেকে মানবতার মৌচাক পর্যন্ত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন