কলকাতার কাছেই পাহাড়, জঙ্গল এবং ঝর্ণায় ঘেরা সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ

Simlipal Tour

কলকাতার কাছেই জঙ্গল অথচ একটা সময় যে জায়গাটায় বেড়াতে যাবার নাম করলে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠতো তার নাম সিমলিপাল। বাংলা এবং উড়িষ্যা সীমান্ত বরাবর মাওবাদীরা রাজত্ব করেছে বেশ কিছুটা সময়। মানুষ খুন, তোলা আদায় চলতো নিত্যদিন। কলকাতা থেকে সিমলিপাল যাবার রাস্তা জঙ্গলমহলের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার মধ্যেই পড়ে। একটা সময় বেলপাহাড়ি জঙ্গল মাওবাদীদের জন্যই বিখ্যাত হয়েছিল। রাতেরবেলা এই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল ছিল আতঙ্কের। গত এক দশক ধরে সেই আতঙ্ক আর নেই। সেই কারণে সিমলিপালে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের সংখ্যা বেড়েছে দিন দিন। 

কলকাতার কাছে একদিনের ঘোরার জায়গা জানতে চাইলে আমি সিমলিপাল যেতে বলবো। সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান হলো ভারতবর্ষের উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জ জেলার বাঘ সংরক্ষন কেন্দ্র। কলকাতা থেকে মাত্র ৫ ঘন্টার দূরত্বে সপ্তাহান্তে বেড়াতে যাবার সেরা জায়গা বলা যায়। যেখানে পাবেন পাহাড়, ঘন জঙ্গল এবং ঝর্ণা। যা দেখলে বারবার যেতে ইচ্ছা করবে। 

কি কি দেখবেন সিমলিপালে?

সিমলিপাল ভ্রমণে আপনি পাবেন জঙ্গলে ভরা পাহাড়। এই জঙ্গলে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে দিনের আলো পর্যন্ত ঢোকেনা। তাই কিছু জায়গা খুব স্যাঁতসেঁতে এবং অন্ধকার। দেখতে পাবেন কিছু আদিবাসী গ্রাম। সোনা যায় একটা সময় উড়িষ্যা সরকার এই আদবাসীদের জন্য জঙ্গলের বাইরে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলো। কিন্তু এক দেড় মাস যাবার পরেই সবাই আবার জঙ্গলে ফিরে যায়। এর দুটো কারণ থাকতে পারে।  এক, পুরানো জীবন ছেড়ে নতুন জীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে অসুবিধা নয়তো দ্বিতীয় কারণ হিসাবে বলা যায় জঙ্গলে ওদের উপার্জন অনেকটাই বেশি। 

আর যেটা দেখতে পাবেন সেটা হলো হরিণ। সারাদিন বাঘ দেখার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় এবং বিকেলবেলা হরিণ দেখে বাড়ি ফিরতে হয়। হরিণ দেখতে পাবেন বিকেলবেলা চাহালাতে। ওখানে খাবার দেওয়া হয় হরিণদের জন্য। জঙ্গলে ঘুরতে দারুন লাগবে। একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হবে। জঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম পরিবেশ আপনার মনকে আনন্দ দেবে। জঙ্গলের পরিবেশ দেখে বাঘ আছে বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু বাঘের দেখা মিলবেনা এটা বলাই যায়। তাই সেই আশা করবেন না। আর দেখবেন ময়ূর ও অন্যান্য পাখি। 

এই সিমলিপালের সাথেই ঘুরে নিতে পারেন আরো একটা সুন্দর জায়গা, যেটার নাম দেবীকুন্ড জলপ্রপাত। বারিপদা থেকে মাত্র ২ ঘন্টার দূরত্বে। একটা দিন এখানে অবশ্যই যাবেন খুব ভালো লাগবে। এটাও জঙ্গল পথ ধরে যেতে হয়। সুন্দর পরিবেশ। 

Simlipal Tour

কিভাবে ঘুরবেন সিমলিপাল কিভাবে যাবেন এবং ঘুরবেন সিমলিপাল?

২ রাত ৩ দিনের বা ৩ রাত ৪ দিনের প্ল্যান করতে পারেন। সেটাই ভালো হবে সব কিছু দেখার জন্য। প্রথম দিন ধর্মতলা থেকে বাস ধরে নিন বারিপদার জন্য। মোটামুটি ৫ ঘন্টা লাগবে পৌঁছাতে। ওখানে পৌঁছে হোটেল দেখে নিতে পারেন নিজের পছন্দ মতো। বিভিন্ন বাজেটের হোটেল ওখানে পাবেন। তবে বারিপদার কাছেই আছে হোটেল অম্বিকা। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এবং গাড়ি বুকিংও করে দিতে পারে সমস্ত ভ্রমণ স্থানের। তবে গাড়ি শেয়ার করার অপসন থাকলেও ওরা ইচ্ছাকৃত করতে চায়না। এটা নিজেরা দেখে নেবেন। হোটেল রেপশনে বসে থেকে করে নিতে পারেন। 

খুব সকালে বেরোতে হয়। যত আগে যাবেন তত ভালো। প্রথম দিকের গাড়িতে থাকলে অনেক প্রাণী দেখা যায়। যত বেশি গাড়ি ঢুকবে প্রাণীরা তত গভীর জঙ্গলে ঢুকে যাবে। সকাল ৫:৩০ থেকে গাড়ি ছাড়তে শুরু করে। গাড়ি ভাড়া পর্বে ৪০০০ টাকার মতো। সকাল ৯ টার মধ্যে জঙ্গলে ঢোকার পারমিশন নিতে হয়। তাই দেরি করা চলবে না। সারাদিন ওখানেই কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা হোটেলে ফিরবেন। 

দ্বিতীয় দিন প্ল্যান করুন দেবীকুন্ডর জন্য। এটা ২ ঘন্টার মতো দূরত্ব। এটার কোনো নির্দিষ্ট গাড়ি ভাড়া নেই। ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে গাড়ি পেয়ে যাবেন। এখানেও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বেন।  গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের পথ ধরে অনেকটা হাঁটতে হয়। সুন্দর পরিবেশ দেখতে দেখতে দিনটা ভালোই কাটবে। 

Devi Kund Waterfall

বিকেল বিকেল হোটেলে ফিরে যান। বারিপদা থেকে কলকাতার বাস থাকে রাত ১০টা নাগাদ। যদি সেদিনের বাসের টিকিট কাটা থাকে তাহলে রাতের খাওয়া সেরে বাস ধরে নেবেন। আর যদি পরের দিন রাতের টিকিট কাটা থাকে তাহলে পরের দিন আরো একটা ভালো জায়গা ঘুরতে পারবেন। 

তৃতীয় দিন হোটেল ছেড়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন চাঁদিপুরের উদ্দেশ্যে। বারিপদা থেকে চাঁদিপুরের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটারের মতো। সময় লাগবে দেড় ঘন্টা। ওখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে যেতে পারেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। ওখান থেকে দূরত্ব কমবেশি ৩৮ কিলোমিটারের মতো। সব দেখে খাওয়াদাওয়া করে সন্ধ্যেবেলা ফিরে আসুন বারিপদা। রাতের খাওয়াদাওয়া করে বাস ধরে নিন কলকাতার। পরদিন সকালে কলকাতা পৌঁছে যাবেন। 

Chandipur Sea Beach

কখন যাবেন সিমলিপাল?

সিমলিপাল যেহেতু জঙ্গল তাই বর্ষাকালে বন্ধ থাকে। নভেম্বর থেকে জুন খোলা থাকে সিমলিপাল। শীতের শুরুতে বা শীতের শেষে যাওয়া ভালো। অনেকেই সিমলিপাল জঙ্গলে ভয়ঙ্কর মশার কথা বলে থাকেন। তবে আমার সেটা একবার মনে হয়নি। গাড়ি চালকদের সাথেও কথা বলে দেখেছি অমন কোনো মশার উৎপাতের কথা শোনা যায়নি। তবুও যদি ভয় পান তাহলে মশার ওষুধ সঙ্গে রাখতে পারেন। 

সিমলিপাল ঘুরতে খাওয়াদাওয়া কিভাবে করবেন?

আমরা যারা আগেও জঙ্গলে ভ্রমণ করেছি তারা জানি যে জঙ্গল ভ্রমণে গেলে শুকনো খাবার অনেকটাই রাখতে হয় সঙ্গে। কারণ জঙ্গলের মধ্যে খাবারের দোকান পাওয়া যায় না। রাতের খাবার হোটেলেই পেয়ে যাবেন কিন্তু দিনের খাবার জঙ্গলেই করতে হবে সেটা মনে রাখবেন। তাই প্রচুর ফল বিস্কুট ছোলা বাদাম সঙ্গে রাখবেন নিজেদের গ্রুপের জন্য। অবশ্যই পরিমান মতো জল রাখবেন সঙ্গে। 

সব শেষে আর একটা কথা বলে রাখি। জঙ্গলে বেড়াতে গেলে গাড়ির চালকের সাথে আগে ভালো করে বন্ধুত্ব করে নেবেন। তাহলে ওরা এমন অনেক জায়গা ঘোরাবে যেখানে অন্য গাড়ি যায়নি। ওরা এটা এক্সট্রা টাকার জন্য করে থাকে। সেটা আপনি দিতেও পারেন নাও দিতে পারেন। 

মন্তব্যসমূহ