এই তারিখে
গুয়ে মঠ
বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস
লাহুল-স্পিটি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সমুদ্র যখন অস্থির হয়ে উঠে, তখন সে ইতিহাসের কথা বলে না। কিন্তু যখন সে শান্ত হয়, তখন তার গর্জনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার স্মৃতি। এমনই এক স্মৃতির নাম — মহাবলীপুরম। আর তার বুকে স্থির হয়ে থাকা এক কালজয়ী কীর্তি — শোর টেম্পল। এটা শুধু একটা মন্দির নয়, এটা এক সময়ের কথা বলে, রাজত্বের কথা বলে, বলে বিশ্বাস, স্থাপত্য আর সমুদ্রবিজ্ঞান — সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মহাকাব্য। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটা প্রতিদিন হাজারো পর্যটককে আকর্ষণ করে, কিন্তু এর গভীরে লুকিয়ে আছে রহস্য, কিংবদন্তি এবং এক মহাকাব্যিক অতীত।
এই ব্লগে, আমরা শোর টেম্পলের ইতিহাস, স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং এর পেছনের অলৌকিক কাহিনী নিয়ে এক যাত্রায় বের হব—যেখানে প্রতিটা পাথর কথা বলে, প্রতিটা খোদাইয়ে লুকিয়ে আছে একেকটা গল্প।
যাত্রা শুরু হয় এক ভোরবেলা। আমার গন্তব্য ছিল তামিলনাড়ুর কোলাহল মুক্ত উপকূল — মহাবলীপুরম, যা মমল্লপুরম নামে অধিক পরিচিত। চেন্নাই থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ। রাস্তার একপাশে সমুদ্র, অন্যপাশে নারকেল গাছের সারি, মাঝখানে চলছিল আমার গাড়ি — যেন সময়ের স্রোতের উপর দিয়ে চলা এক ছোট নৌকা।
রাস্তার কোলাহল পেরিয়ে যখন মহাবলীপুরমে পৌঁছলাম, তখন সূর্য সমুদ্রতটে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সামনে দিগন্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই অতিপ্রাচীন মন্দির — শোর টেম্পল।
এই মন্দির শুধু চোখের আরাম নয় — এটা এক ইতিহাসের স্তম্ভ। সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত, পল্লব রাজবংশের মহান রাজা নরসিংহবর্মন-এর আমলে নির্মিত হয় এই মন্দির। তিনি শুধু একজন রাজা ছিলেন না, ছিলেন এক সুগভীর দর্শনের স্থপতি। তাঁর নেতৃত্বে পল্লব রাজারা স্থাপত্যের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করেছিলেন।
"মামল্লপুরম" নামটা এসেছে রাজা নরসিংহবর্মণের ডাকনাম "মামল্ল" (মল্লযোদ্ধা) থেকে। কথিত আছে, তিনি একজন মহান যোদ্ধা ছিলেন এবং এই শহরকে তার বিজয়ের স্মারক হিসেবে গড়ে তোলেন।
শোর টেম্পল হচ্ছে সেই যুগের সর্বশেষ নিদর্শন। একসময়ে এই এলাকায় ছিল সাতটা মন্দির — “Seven Pagodas” নামে পরিচিত। আজ সাগরের গহীনে তলিয়ে গেছে বাকিগুলো, কেবল এই একটাই দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মোকাবিলায়।
আমি যখন মন্দিরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়ালাম, তখন প্রথম যে বিষয়টা মন কাড়ল — তা হলো এই মন্দির যেন এক শক্তিশালী দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ, যা কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং সাহসিকতারও প্রতীক।
এই মন্দির গঠিত হয়েছে গ্রানাইট পাথরে, যা কাছাকাছি কোনও পাহাড়ে ছিল না। এই পাথর দূর থেকে আনা হয়েছিল, এবং হাতে খোদাই করে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিটা খুঁটি, প্রতিটা স্তম্ভ, প্রতিটা দেবমূর্তি। মন্দিরের মুখ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সমুদ্রের দিকে, যা বেশ বিরল। এর মূল গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন ভগবান শিব — লিঙ্গম রূপে, আর তার পেছনের দিকটায় আরও এক ছোট গর্ভগৃহ — যেখানে অবস্থান করছেন ভগবান বিষ্ণু শয়নরত অবস্থায়।
মন্দিরের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছে নন্দি বলদের মূর্তি, যারা পাহারা দেয় এই পবিত্র স্থানকে।
অদ্ভুত এক স্থাপত্য কৌশল এখানে ব্যবহৃত হয়েছে — সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর জলের ঢেউ থেকে বাঁচানোর জন্য পুরো মন্দির এক ধরণের উঁচু পাথরের মঞ্চের উপর নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের গায়ে থাকা খোদাইগুলো — যুদ্ধের দৃশ্য, দৈত্য, দেবতা, প্রাণী — সবই বলে সেই সময়ের সমাজ, সংস্কৃতি আর দার্শনিক চিন্তার কথা।
সেই সময় এই এলাকায় ছিল এক স্থাপত্য স্কুল, যেখানে শিষ্যরা শিখত পাথর খোদাই, মূর্তি গঠন এবং মন্দির নির্মাণের পদ্ধতি। তাই আশেপাশের রথ মন্দিরগুলো — পঞ্চ রথ (যেমন: দ্রৌপদী, অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির এবং সহদেব রথ) — সবই সেই স্থাপত্য শিক্ষার অংশ।
তবে শোর টেম্পল ছিল সেই চূড়ান্ত সৃষ্টি, যেখানে প্রতিটা নকশা, প্রতিটা ভাস্কর্য পল্লব রাজাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।
লোককথায় আছে, একবার মহাবলীপুরমে এক দেবতা বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন ৭ দিনের জন্য, আর তার ফলে ডুবে যায় শহরের অধিকাংশ অংশ। সমুদ্র গিলে ফেলে সেই সাতটা মন্দিরের ছয়টা। কিন্তু একমাত্র শোর টেম্পল দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনও অলৌকিক শক্তির অভিভাবক।
২০০৪ সালের সুনামির পর, যখন সমুদ্র কিছুটা পেছনে সরে যায়, তখন সমুদ্রতটে দেখা যায় প্রাচীন মন্দিরের কিছু ভিত্তি — যা সেই কিংবদন্তিকে বাস্তব রূপ দেয়। গবেষকরা আজও গবেষণা করছেন, ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে সেই হারিয়ে যাওয়া প্যাগোডাগুলো।
আমি বসেছিলাম মন্দিরের এক কোণে, পাথরের উপর। সামনে প্রশান্ত সমুদ্র, বাতাসে ভেসে আসছে নোনা গন্ধ। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পেছনে ঢেউয়ের শব্দ, সামনে পাথরের ভাস্কর্য — যেন যুগ যুগ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও সন্ন্যাসী, যে যুগের গর্জন শুনেছে, দেখেছে সভ্যতার উত্থান-পতন, কিন্তু নিজে অবিচল থেকেছে।
মহাবলীপুরমের শোর টেম্পল কেবল একটা স্থাপত্য কীর্তি নয় — এটা ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। এখানে সময় থেমে থাকে, কেবল মন কথা বলে পাথরের সাথে।
স্থানীয়রা বলে, রাতের বেলা মন্দির থেকে মন্ত্রোচ্চারণের আওয়াজ শোনা যায়। কেউ কেউ দাবি করেন, তারা সমুদ্রের মধ্যে আলোর গোলক দেখেছেন, যা মন্দিরের রহস্যময় শক্তির ইঙ্গিত দেয়।
মহাবলীপুরমের শোর টেম্পলে এসে মনে হল, আমি কেবল একটা প্রাচীন মন্দির দেখিনি — আমি ছুঁয়ে এসেছি সেই সময়কে, যখন রাজারা ছিলেন দার্শনিক, স্থপতিরা ছিলেন কবি, আর ধর্ম ছিল চেতনার প্রকাশ।
যদি আপনি ইতিহাস ভালোবাসেন, স্থাপত্যে মুগ্ধ হন, কিংবা কেবল একটুখানি নিস্তব্ধতা চান — তাহলে এই মন্দিরে একবার অবশ্যই আসা উচিত।
শোর টেম্পল এখন ইউনেস্কো ও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রতি বছর এখানে মহাবলীপুরম ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল-এর আয়োজন করা হয়, যেখানে শাস্ত্রীয় নৃত্যের মাধ্যমে মন্দিরের ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়।
লোকেশন: চেন্নাই থেকে ৫৬ কিমি দূরে।
সেরা সময়: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি।
টিকিট: ভারতীয়দের জন্য ৪০ টাকা আর বিদেশীদের জন্য ৬০০ টাকা।
সময়: সকালে ভোরবেলা বা সূর্যাস্তের সময় আসা সবচেয়ে ভালো। আলো তখন মন্দিরের উপর সোনালী রঙ ছড়িয়ে দেয়।
গাইড: স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে ঘুরলে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়।
সতর্কতা: মন্দির সংরক্ষণের জন্য অনেক জায়গায় প্রবেশ নিষেধ, সেই নিয়ম মেনে চলুন।
একদিন হয়তো আমরা হারিয়ে যাওয়া সেই সাতটা মন্দিরের চিহ্ন আবার আবিষ্কার করব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত, শোর টেম্পল আমাদের মনে করিয়ে দেয় — পাথর যখন কথা বলে, তখন ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে।
আপনি যদি এই পোস্টটা পড়ে থাকেন, তবে মনে রাখবেন — সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন মন্দিরটা আজও অপেক্ষা করছে আপনার একটিবার ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য।
মহাবলীপুরমের পাথরে খোদাই করা ইতিহাস, একবার অন্তর দিয়ে দেখুন — আপনি নিজেও সময়ের সাক্ষী হয়ে যাবেন।
আমার এই যাত্রা কেমন লাগলো? আপনি কি শোর টেম্পল দেখেছেন? কোন রহস্য বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চান? কমেন্টে লিখুন!
#মহাবলীপুরম #শোরটেম্পল #ইতিহাস #ভারতীয়স্থাপত্য #পল্লবরাজবংশ #অ্যাডভেঞ্চার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন