এই তারিখে
গুয়ে মঠ
বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস
লাহুল-স্পিটি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সীমাহীন বরফে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষে, যেখানে সূর্যোদয় মানে সোনালি আগুনে মোড়া আকাশ, সেখানে ঘুমিয়ে আছে এক স্বপ্নরাজ্য—সিমলা। আজকের আধুনিক দুনিয়ায় এটা কেবল এক ট্যুরিস্ট স্পট নয়, এটা ইতিহাসের ক্যানভাসে আঁকা এক জীবন্ত কাহিনী, যেখানে রাজনীতি, ভালোবাসা, কূটনীতি, সাহসিকতা আর প্রকৃতির কবিতা একসাথে মিশে গিয়েছে।
সিমলার প্রথম পরিচয় ইতিহাসে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। ১৮১৯ সালে, লেফটেন্যান্ট রস নামে এক ব্রিটিশ অফিসার প্রথম এই পাহাড়ি গ্রামটার প্রতি আকৃষ্ট হন। তখনও সিমলা ছিল অজানা, অচেনা এক বনভূমি। স্থানীয় গোর্খা, ঠাকুর ও পাহাড়ি উপজাতিরা তখনও জানত না, এই পাহাড় একদিন সাম্রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হয়ে উঠবে।
১৮৬৪ সালে, ভারতবর্ষের তৎকালীন ভাইসরয় জন লরেন্স ঘোষণা করেন—সিমলা হবে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। তারপর থেকেই শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। কাঠের কটেজ, গথিক গির্জা, ব্রিটিশ ক্লাব, ম্যাল রোড—সেগুলো যেন একে একে সিমলাকে গড়ে তোলে একটা ইউরোপীয় শহরের আদলে।
ম্যাল রোডে হাঁটলে আজও মনে হবে, যেন সময় থেমে আছে। হাতের ডান পাশে হিমালয়ের চূড়া, আর বাঁ দিকে সেই ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন—গথিক টাউন হল, ন্যায়ালয়, ও ঘন্টাধ্বনির ঐতিহাসিক চার্চ। সিমলার এই রোমান্টিক আবহাওয়ায় অনেক ব্রিটিশ অফিসার প্রেমে পড়েছেন স্থানীয় মেয়েদের, সেই গল্পও ছড়িয়ে আছে অলিগলিতে।
সিমলা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত হয়নি। ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে, সিমলা সাক্ষী ছিল ভারতের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বৈঠকের—সিমলা কনফারেন্স।
জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মাউন্টব্যাটেন—তাদের উত্তপ্ত আলোচনার প্রতিধ্বনি আজও যেন ভেসে আসে ভাইসরয় লজের পাথরের দেয়াল ঘেঁষে।
এই বৈঠক ছিল ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির এক পূর্ব সংকেত।
সিমলার কথা বললেই মনে পড়ে সেই ছোট্ট খেলনা ট্রেনটার কথা—কালকা-সিমলা রেলওয়ে। ১৯০৩ সালে চালু হওয়া এই ট্রেন এখন ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট।
এই ট্রেন আপনাকে নিয়ে যাবে ৯৬ কিমি দীর্ঘ এক সাপের মতো পথে, ৮৭৮টি বাঁক, ১০৩টি সুড়ঙ্গ আর ৯০০টির বেশি ব্রিজ অতিক্রম করে।
জানালার বাইরে কখনও পাহাড়ি ঝর্ণা, কখনও ঘন দেবদারু বন, আবার কখনও সূর্যোদয়ের হালকা আলো—এই যাত্রা কেবল এক ট্রেন ট্রিপ নয়, এটা এক স্মৃতির ট্রাভেলগ।
সিমলার রাজপথে হাঁটলেই চোখে পড়ে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য। ক্রাইস্ট চার্চ, গারটন ক্যাসেল, স্ক্যান্ডেল পয়েন্ট—এসব কেবল ইট-পাথরের গঠন নয়, প্রত্যেকটা স্থানে লুকিয়ে আছে প্রেম, বিদ্রোহ আর অপেক্ষার কাহিনি।
স্ক্যান্ডেল পয়েন্টের গল্প তো কিংবদন্তি। বলে, পটিয়ালার রাজকুমারী এক ইংরেজ অফিসারের প্রেমে পড়েন। সমাজ তাঁদের মেনে নেয়নি। রাজকুমারী সেই প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যান এখান থেকেই। সেই ঘটনা এই জায়গাটিকে “স্ক্যান্ডেল পয়েন্ট” নাম দেয়—যেখানে প্রেম আর প্রতিবাদের হাত মিলে যায়।
দুসেহরা, লোসর, শৈল উৎসব—এসব যেন প্রাকৃতিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ এক জীবন্ত নাটক।
খাবারেও আছে পাহাড়ি ছোঁয়া। চানা মাদ্রা, দাৎরু, থুক্পা, আর মাখনমাখা পাহাড়ি পরোটা—এইসব খাবার আপনাকে বুঝিয়ে দেবে, স্বাদও ইতিহাস বহন করে।
শীতকাল এলেই সিমলা রূপ নেয় বরফের রাজ্যে। কুফরি, নালদেড়া, মাশোবর, ফাগু—এসব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে সাদা চাদর। বরফে স্কিইং, আইস স্কেটিং কিংবা স্নোম্যান বানানো—সেগুলো শুধু অ্যাডভেঞ্চার নয়, জীবনের আনন্দও বটে।
সিমলায় শীতকালে রাত মানে কাঠের কটেজে আগুনের উষ্ণতা আর বাইরের ঠান্ডায় জমে যাওয়া জানালার কাঁচ। পাহাড়ি বাতাসে বাজে কোন এক অদৃশ্য বাঁশির সুর।
আমার দেখা বরফে মোড়া রূপকথার শহর
যখন আপনি সিমলায় পা রাখবেন, তখন আপনি কেবল এক শহরে যাচ্ছেন না—একটা কাহিনিতে প্রবেশ করছেন।
এখানে আপনি পাবেন ইতিহাসের গন্ধ, প্রেমের ছোঁয়া, প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি।
🔹 যেতে হলে:
কলকাতা বা দিল্লি থেকে ট্রেনে কালকা হয়ে সিমলা পৌঁছানো যায়। অথবা সরাসরি গাড়ি বা ফ্লাইটেও যেতে পারেন।
🔹 কোথায় থাকবেন:
হেরিটেজ হোটেল অথবা কটেজ টাইপ হোমস্টে—দুটোরই অভিজ্ঞতা আলাদা।
🔹 কি খাবেন:
অবশ্যই ট্রাই করুন চানা মাদ্রা আর পাহাড়ি রাজমা। স্থানীয়দের সঙ্গে বসে পাহাড়ি চায়ে চুমুক দিন, বুঝবেন সময় থেমে যেতে পারে।
🔹 সেরা সময়:
শীতকালে গেলে বরফ পাবেন, গ্রীষ্মে গেলে পাবেন ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানোর স্বস্তি। মন চাইলে বর্ষাতেও যান—সিমলা তখন সবুজের চাদরে মোড়া।
🔹 শেষ কথা:
Shimla isn’t just a place—it’s a memory.
একবার গেলে মনে হবে, আপনি ফিরে আসবেন আবার। আর ফিরে এসে বলবেন—"হ্যাঁ, আমি একবার সিমলা ঘুরে এসেছি, কিন্তু মন আজও রয়ে গেছে ওই বরফে মোড়া গলিতে।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন